গারো নিউজ টুয়েন্টিফোর ডেস্ক,
বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা, মোট গোত্রের সংখ্যা নিয়ে সরকারি বেসরকারিভাবে নানা মতভেদ রয়েছে। সংখ্যার বিচারে যাই হোক, প্রতিটা জাতিগোষ্ঠীর কাছেই নিজস্বতা প্রাধান্য পায়। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবাই কমবেশি চেষ্টা করে চলেছেন। তেমনি গারো সমাজের তেরটি গোত্রের একটি গোত্র লিঙাম, যা মেগাম বা মিগাম নামেই অধিক পরিচিত জনগোষ্ঠীর লোকেরা বিশ্বায়ণের এই যুগে নিজেদের মেলে ধরতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই মেগাম জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের লিঙাম পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার ভারত সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা থানার ৮নং রংছাতী ইউনিয়নের তেরটি গ্রামে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। তারা যেসব গ্রাম গুলোতে বসবাস করেন সেসব গ্রামের নাম গুলো হলো: দ্বীপপুর, বেংকোনা, মহাদেও, ছোট মনগড়া, বড় মনগড়া, বড়দল, কান্দাপাড়া, বরুয়াকোণা, পাতলাবান, সন্যাসীপাড়া, জাগিরপাড়া, পাচঁগাও এবং নংক্লাই। লিঙামদের মোট জনসংখ্যা : ২,৭৪৮ জন ; তার মধ্যে নারী: ১,৩৩৭ জন, পুরুষ: ১,৪১১ জন, মোট পরিবার: ৪০৫ । এটি একটি জরিপের প্রতিবেদন। জরিপটি স্বীয় গোত্রের অভিভাবক পর্যায়ের সংগঠন ”বাংলাদেশ গারো লিঙাম (মেগাম) এসোসিয়েশন” – এর প্রতিষ্ঠাতা মি: পিটারসন কুবি পিটারের পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগে গত বছর ২০২১ খ্রীষ্টাব্দে তথ্য সংগ্রহ করে সহযোগিতা করেন সংগঠনের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক মি: প্রভাত নংউড়া। স্বীয় জাতির কল্যাণের স্বার্থে পূর্বে আরেকটি ”লিঙাম ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন” নামে সংগঠন ছিল। শুরুতে নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে এ সংগঠন সফলতা পেলেও পরবর্তীতে নানা প্রতিকূলতার কারণে তা আর বেশিদূর এগুতে পারেনি। বর্তমান ২০২১ সালের ১৬ আগস্টে জম্ম নেয়া সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পিটারসন কুবির উদ্যোগে নিজের জাতি গোষ্ঠীর ভাষা সংস্কৃতিকে বিশ্বের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার জন্য ফেইসবুক পাবলিক গ্রুপ BD Lyngam (Megam) Language , নিজেদের গোত্রের লোকদের সাথে পারস্পারিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে মেসেন্জারে Conversation For The Nation নামে, ফেইসবুকে Bangladesh Garo Lyngam (Megam) Welfare Association নামে প্রাইভেট গ্রুপ ক্রিয়েট করেন। উনার তাগিদবোধ ও উৎসাহে কিছু স্বগোত্রীয় যুবাদের সহযোগিতায় লিঙাম (মেগাম) অধ্যষিত বেশ কিছ গ্রাম গুলো আলাদা করে সোস্যাল মিডিয়া ফেইসবুক ভিক্তিক গ্রুপ খোলা হয় যা পারস্পারিক সুসম্পর্ক বৃদ্ধিতে এবং লিঙাম গোত্রকে তুলে ধরতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
উল্লেখ্য সেসব গ্রাম ও এডমিনবৃন্দরা হলেন- দ্বীপপুর এবং বেংকোনা যুব সংগঠন – এডমিন মি: সালগিও নংমিন, BORO MONGORA Social Welfare Association –এডমিন মি: সৌরভ পি নংমিন, কান্দাপাড়া যুব পরিবার – এডমিন মি: হিমেল কুবি, সন্যাসীপাড়া ঐক্য যুব সংগঠন – এডমিন মি: লন্দাস লিখন কুবি, জাগিরপাড়া চংসন যুব সংগঠন – এডমিন মি: বিভব ঘাগ্রা, নংক্লাই লিঙাম যুব সংগঠন – এডমিন মি: বিশাল রংরিন, মেসেন্জারে পাচগাঁও – এডমিন মিসেস্ সারা হাচ্চা। নিজেদের তাগিদেই স্বীয় গ্রামের লোকদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে যারা আগে থেকেই ফেইসবুক গ্রুপ খুলেছেন – পাতলাবান যুব সংগঠন – এডমিন রিজন হাপাং, ছোট মনগড়া যুব সংগঠন- এডমিন রুবেল ঘাগ্রা, মেসেন্জারে নংসড়ক পরিবার/মহাদেও – এডমিন পলিকার্প দিখার। এরা সবাই বর্তমান প্রজন্মের সন্তান, স্বীয় লিঙাম (মেগাম) সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।
লিঙাম গোত্রের বয়োজ্যেষ্ঠ যিনারা বিভিন্ন সময়ে স্বীয় ভাষা সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন উনারা হলেন – মি: সুরেশ নংমিন, সুজানা হাচ্চা, মি: লুয়ের নংমিন, মিসেস্ প্রীতিলতা কুবি, মি: অবনী নংমিন, মিসেস্ অন্তিমা ময়না নংমিন, মি: আলফন্স নংমিন প্রমুখ। লিঙাম জনগোষ্ঠীর ছাত্রদের সংগঠন “লিঙাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন” স্বীয় এলাকা কলমাকান্দা, ময়মনসিংহ, ঢাকায় স্বগোত্রীয় লিঙাম স্টুডেন্টদের নিয়ে বিভিন্ন সেমিনার, বাৎসরিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করেও স্বীয় ভাষা সংস্কৃতি রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এতসব কিছুর মাঝে একটি খুশির খবর এই যে, লিঙাম গোত্রের ভাষার বর্ণমালা আবিষ্কার করেছেন মি: সুরেশ আলবার্ট নংমিন। অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। উনি বেশ কিছু গান ও কবিতা লিঙাম ভাষায় রচনা করেছেন। উনার আবিষ্কৃত অক্ষরের মাধ্যমে উনার শিক্ষাদানে অনেক লিঙাম ছেলেমেয়ে নিজের ভাষায় এক সময় পড়তে লিখতে পারলেও চর্চার অভাবে এখন তা অনেকে ভুলতে বসেছে। সরকারি বেসরকারি অর্থায়ণ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে লিঙাম ভাষার ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও চর্চা বেশিদূর আগাতে পারিনি। সংস্কৃতিমনা কোনো ধনাঢ্য উদার ব্যক্তি বা দেশি বিদেশি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়তো গারো সমাজের লিঙাম গোত্রের ভাষার বর্ণমালার চর্চা ও বাস্তব প্রয়োগ আরও বাড়তো এবং এতে বিশ্বে অন্যান্য জাতির সামনে মাথা উচুঁ করে গর্বের সাথে সামনে এগোতে পারতো, ভাষা পাকাপোক্ত সংরক্ষণের একটি সুব্যবস্থা হতো।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে স্বীয় ভাষাকে আরো পাকাপোক্ত করতে, সংরক্ষণ করতে নিজস্ব লিঙাম ভাষার অভিধান (ডিকশনারি) লিখতে শুরু করে দিয়েছেন মি: পিটারসন কুবি। পেশায় উনি একজন শিক্ষক। তিনি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে মাঝে মধ্যে লেখালেখিও করে থাকেন। উনার লেখা কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধে সমাজের, স্বগোত্র লিঙাম সমাজের নানা বিষয়ের অবতারনা করতে দেখা যায়। ইদানীং তিনি বেশ কিছু বাংলা ও হিন্দি গানের নিজের গোত্রের লিঙাম (মেগাম) ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং কিছু গানে নিজেই কণ্ঠও দিয়েছেন। তিনি যেসব গানের লিঙাম ভাষায় অনুবাদ করেছেন সেগুলো হলো: মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা, বলবো না গো আর কোনদিন ভালবাসো তুমি মোরে, হারানো হিয়ার নিকুন্জ পথে, অতীতের কথা গুলো পুরোনো স্মৃতি গুলো, একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর, ভালোবাসার মতো ভাল বাসলে তারে কি ভুলা যায়, আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়, সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান কর না, নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা, এই কি গো শেষ দান, দুটি মন আর নেই দুজনার, বড় সাধ জাগে, চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ও আমার দেশের মাটি ইত্যাদি। মিউজিক কম্পোজিশনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পেলে আরও বহুদূর আগাতে পারবেন বলে আশা রাখেন। মেগাম ভাষায় বেশ কিছু কবিতা ও গান রচনাও করেছেন। বর্তমান প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেগাম গোত্রের ছেলেমেয়েরা লেখালেখির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে মি: প্রভাত নংউড়া, মি: রিংখেং নংউড়া, মি: শিমুল নংউড়া, মি: পনুয়েল হাচ্চা, মি: ফিলিপ নংউড়াসহ অনেকেই নিজের ভাষায় গল্প, কবিতা লেখার চর্চা করে যাচ্ছেন।
শুধু ভাষা সংস্কৃতি নয়, অন্যান্য বিষয়ের স্বীয় গোত্রের বর্তমান লিঙাম (মেগাম) ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন সংগঠনের সভাপতি মি: সুরন্জন হাজং, সহ সভাপতি মিসেস সুজয়া ঘাগ্রা ও মি: বিপ্লব কুবি, সমাজকল্যাণ সম্পাদক মি: বাবুল নাফাক ও অন্যান্য সদস্যগণ পরোক্ষ প্রত্যক্ষভাব কলমাকান্দার বরুয়াকোনায় বেআইনীভাবে অবৈধ বালি ও পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে আলোচিত ”মহাদেও নদী রক্ষা কমিটি”কে সার্বিক সহযোগীতা করে মানব বন্ধন সমাবেশকে আরও বেগবান করে তুলতে সাহায্য করেছেন। শুধু ভাষা সংস্কৃতি রক্ষাই নয়, সংগঠনটি নতুন হিসেবে প্রতিষ্ঠার বছরেই ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ সালে বস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি, প্রতিটা গ্রামের লিঙাম পরিবারে ফ্রি ক্যালেন্ডার বিতরণ, লিফলেট প্রদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, অনলাইন মিটিংয়ের মাধ্যমে স্বীয় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ফেব্রয়ারি ভাষার মাসে অনলাইনে নিজের লিঙাম ভাষায় কবিতা ও গানের প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছে। স্বীয় জাতিগোষ্ঠীর পত্রিকা প্রকাশ করা, একটি স্বতন্ত্র্য ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেল খোলাও তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে। বিশ্বায়ণের এই যুগে সবার সাথে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের সাথে তাল মেলাতে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লিঙাম গোত্রের একই উপাধীধারীর সংগঠন যা গারো ভাষায় “মাহারী” সংগঠনের ছায়াতলে মাসিক বা বাৎসরিক অর্থ সঞ্চয় করছে, নিজেরাই সমস্যার সমাধান করে ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির পরিবেশ বজায় রেখে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের মাত্র একটি ইউনিয়নে স্বল্প সংখ্যক বসবাসকারী গারো সমাজের লিঙাম (মেগাম) জনগোষ্ঠীর লোকেরা জীবন সংগ্রামে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টার কমতি রাখছে না। এক্ষেত্রে অগ্রগতির পথে এগোতে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর ব্যক্তি, সমাজ, সংস্থা সংগঠন পর্যায়ে একান্ত সহযোগিতারও প্রয়োজন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for supporting