এক
১৯৯৪-৯৫ সাল।
আমার বন্ধু প্রদীপ কুমার সরকার। নটর ডেম কলেজে এক সাথে পড়তাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হলাম আর সে ভর্তি হল সাংবাদিকতায়।
আজকের কাগজে সহ-সম্পাদক হিসেবে জয়েন করল। আজকের কাগজ তখন বেশ চলে। ভোরের কাগজও। প্রদীপ আজকের কাগজের সহ-সম্পাদক।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে এই ভিডিও টা ইউটিউবে খুঁজে পেলাম !
একদিন তাঁকে বললাম, "তনু (ছদ্ম নাম) মনে হয় তোকে পছন্দ করে। চুপি চুপি তোর দিকে বার বার তাকায়!"
ও বলল, ধুর! তুই খেয়াল করেছিস, তার দাঁড়ি - মুছ আছে! হাত ভর্তি লোম!
আমি বললাম, "এই দাঁড়ি মুছ, লোম থাকার সাথে ভালোবাসার কী সম্পর্ক? মেয়ে তো ভাল।"
না-রে দোস্ত, হবে না! আমার বুকে প্রেম জাগে না! তুই দেখ!
দুই
দিন যায়। সপ্তাহ যায়। মাস যায়।
একদিন প্রদীপ বলল, দোস্ত, তনু মেয়ে টা অ-ন্নে-ক সুন্দর। তোর কথা ঠিক। আগে ভাল মত তাকাই নাই। ভয়াভহ সুন্দর! আমি অকে ছাড়া বাচুম না দোস্ত! বন্ধু। তুই তনুকে বল, আমি রাজি!
আমি বললাম, "ধুর মিয়া, দাঁড়ি - মুছ, হাত ভর্তি লোম ...
সে বলল, "কই দাঁড়ি, কই মুছ? কই হাত ভর্তি লোম দেখস? আমি তো অসব দেখি না!"
বুঝলাম, বসন্ত এসে গেছে!
তিন
এরপর ওরা আর আমাকে নিয়ে বসে না, আড্ডা দেয় না! আলাদা কোথায় কোথায় বসে!
চার
তনু গ্রীস্মের ছুটিতে বাড়ি গেল ...
ফিরে এলো সিঁথিতে সিঁদুর রাঙিয়ে ...
প্রদীপের কান্না কে আর দেখে? হাতে সিগারেটের পোড়া দাগ। বুকেও কয়েকটা সিগারেটে নিজের ঠেসে ধরা পোড়া ঘা। ওসব কে দেখবে?
আমি অকে বললাম, দেখ দোস্ত, তুই বিশ্ববিদ্যালয় পড়িস। অনেক বুঝিস। জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না। সে তোর সাথে প্রতারণা করে নি। সে জানত না ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এবং সেটা তোর কারণেই।
ও বলল, তুই তো প্রেম করিস নি, বুঝবি কী? 'কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কি সে? ধ্বংসে নি যারে।" বলে সে হু হু করে কাঁদে।
আমি তাকে বললাম, বন্ধু সেই স্কুল জীবনেই এই পাঠ আমার চুকে গেছে। এখন এগুলো নিয়ে আর ভাবি না। টাইম নাই।
কষ্ট হয় না? সে জিগায়।
আমি বললাম, নাহ! কষ্ট হইলে কবিতা লিখি। গান লিখি।
পাঁচ
প্রদীপ আমার কবিতাগুলো দেখতে চায়। দেখে বলে, অসাধারণ! অসম্ভব কবিতা, ভয়াভহ কবিতা। তোর কবিতা গুলো বই আকারে ছাপলে সেই রকম হবে। তরুণ পাঠক লুফে নিবে।
আমি লজ্জা পাই! কী বলে পাগল না কি!
সে ঘেঁটে ঘুঁটে সব কবিতা বের করে। কয়েক টি পত্রিকায় মিতা চৌধুরী, বাবুল আহমেদ, মেঘ রোদ্দুর ছদ্মনামে ছাপা কবিতাগুলো দেখে সে জানাল 'বিমুগ্ধ!'
আসলে বিমুগ্ধ টিমুদ্ধ হবার মত কিছু ছিল না। সে ছ্যাকা খেয়ে প্রেমের কবিতাগুলো লুফে নিয়েছে!
ছয়
প্রদীপ নিজেও কবিতা লেখা শুরু করল। গান লিখল, সুর দিল। তখন গান লিখে, সুর দেয়, নিজেই গান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা ক্যাম্পাসময়! তাঁর খ্যাতি তুঙ্গে!
কিন্তু রাতে আমার রুমের জানালা দিয়ে ফিসফিস করে ডেকে বলল, দোস্ত, বাইরে আয়! কথা আছে।
একই কথা তার। বই ছাপতে হবে! প্রতিদিন একই কাহিনী।
আমিও এক গ্রীস্মের ছুটিতে বিয়ে করে ফিরলাম!
প্রদীপ বলল, খুব কষ্ট পাইছি। তুই আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করতে পারলি? তুই জানিস নীরা তোকে অসম্ভব ভালোবাস ত!
আমি বললাম, কিন্তু আমি তো নীরাকেই বিয়ে করেছি, যে আমারে ছেড়ে চলে গিয়েছিল!
প্রদীপ বেপরোয়া হয়ে গেল। সে পাণ্ডুলিপি রেডি করে ফেলল।
এই সেই করে ৯৭ সাল পাড় হয়ে গেল।
পাণ্ডুলিপি নিয়ে এখন এ প্রকাশনী ও প্রকাশনী ঘুরতে থাকলাম। ২১ টা প্রকাশনী পাণ্ডুলিপি নেড়ে চেড়ে দেখে বলল, "কবিতা পাব্লিক খায় না!"
আমি কথা বলি না। প্রদীপই বলে, "সেই রকম কবিতা। খালি একবার ছাপেন। দেদারসে কাটবে। ইংরেজি সাহিত্যের বাঘা ছাত্র। খালি একবার ছাপেন প্লিজ।"
প্রদীপ কাউকে স্যার বলে। পারলে পা ধরবে আমার জন্য।
আমি বলি, "আমি ভাই আর প্রকাশক টকাশকের কাছে যাতি পারব না! বই না ছাপলে কী হবে? গুষ্টি কিলাই। আর লিখব না!"
একুশ জন প্রকাশকের বেশির ভাগই বলেছে, ১৫ হাজার টাকা দিলে বই ছাপবে!
প্রদীপ বলল, "দোস্ত আমি ৫০% দেই, তুই ৫০% দে! তবুও আমরা বই ছাপবই। একটা সময় আসবে এই প্রকাশকরা তোর পান্ডুলিপির জন্য লাইনে দাঁড়াবে, দেখিস! বলে রাখলাম!"
প্রদীপের 'দেখিস' আর আমাদের জীবনে আসে নি!
আমি তাকে বললাম, নিজেদের টাকায় বই ছাপব তো অন্যের প্রকাশনীর নামে ছাপব কেন? আমরা নিজেরা একটা প্রকাশনী খুলে নিয়ে বই প্রকাশ করি!
প্রদীপ এবার হাউ মাউ করে কানল! আনন্দে সে উদ্বেল! চোখ মুছতে মুছতে বলল, দোস্ত গারো ভাষায় নাম হবে প্রকাশনীর!
আমি বললাম, গুড আইডিয়া। আমরা নাম খুঁজছি! যুতসই নাম পাওয়া যাচ্ছিল না।
পরে আমি নাম দিলাম, 'আদিবাসী প্রকাশনী'।
বইটির নাম ছিল "ভালোবাসায় শরীরের গন্ধ পাই"
প্রদীপ বলল, নাম টা অনেক লম্বা হয়ে যায়। এর চেয়ে যদি তোর একটা কবিতা "ধর্ষিতা শালবন" কবিতার নামে হয়, চলবে ভাল। আমরা হাই ফাইভ করে নাম ঠিক করলাম।
আজকের কাগজের প্রদীপের আরেক সহকর্মী বইটির প্রচ্ছদ করে দিলেন।
আমি আবার বেঁকে বসলাম। আর বই করব না।
গ্রামের বাড়ি গিয়ে চুপ করে বসে থাকলাম।
প্রদীপ বন্ধুদের নিয়ে সেখানে বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে হাজির!
১৯৯৭ কিংবা ৯৮ সাল একুশের বই মেলায় 'আদিবাসী প্রকাশনী' থেকে 'ধর্ষিতা শালবন' প্রকাশিত হল।
এর কয়েক বছর পর আমার অনুজপ্রতীম কমল কর্নেল চিসিম পরমা প্রকাশনী নামে আরেক টি প্রকাশনী সংস্থা খুলে বসল।
একটা বই প্রকাশ করতে কত হয়রানির শিকার হতে হত আজ থেকে ২১ বছর আগেও!
এখন আমাদের অনেক প্রকাশনী সংস্থা আছে - চিবিমা, দাকবেয়াল, থকবিরিম।
কোথাও কোথাও দেখলাম লেখা আদিবাসীদের একমাত্র প্রকাশনী। আবার কেউ কেউ লিখলেন অমুক প্রকাশনীই প্রথম!
আমার অনেক আগে প্রশান্ত জ্যাম্বল, নিতিশ কে দ্রং, জেমস জর্ণেশ চিরান স্যার, সুভাষ সাংমা, সঞ্জীব দ্রং প্রমূখ বই প্রকাশ করেছেন।
কে প্রথম, কে দ্বিতীয় এসব না ভেবে সামনে এগিয়ে যাই। ভালো কাজকে উৎসাহিত করি। তবে ইতিহাস জেনে রাখলে ভাল।
সাত
একবার প্রদীপকে নিয়ে মধুপুরের শালবনে গেলাম। বনে বনে ঘুরলাম। লতাদির বাগদান অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলাম। প্রদীপ সেখানে 'আইও ম গিসিক রাআতা আব্রি সিমব্রি গিপাখো ..। ' গারো গান গেয়ে হাজার মানুষকে মাতিয়েছিল। আমার সেদিনের দৃশ্য টা এখনও চোখে লেগে আছে।
এই আমার বন্ধু প্রদীপ। আমার বন্ধু প্রদীপ ফেইসবুকে নেই। শুনেছি সে নারায়নগঞ্জের কোন এক হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে। আমি তাঁর সাথে কানেক্ট হতে চাই, তাঁর সাথে কথা বলতে চাই। তাঁর সন্ধান চাই।
এই লোকটির কাছে আমার অনেক ঋণ। দেশে আসলে তার গানের এ্যালবাম আমি বাজারে নিয়েই ছাড়ব ইনশাল্লাহ!
২৫ জানুয়ারি, ২০১৮
পুনশ্চঃ আজ ২ রা মার্চ বন্ধু প্রদীপ কুমার সরকারকে খুঁজে পেলাম, অনেক কথা বললাম সেলফোনে ৭ সমুদ্র ১৩ নদীর ওপাড় থেকে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for supporting