জেফিরাজ দোলন কুবি, ময়মনসিংহ থেকে
'মধুপুর সরকারী কলেজঃ অবসরকালে যেমন কেউ বিদায় দেন না, তেমনি কেউ বিদায় পান না' - এমনই হৃদয় বিদারক ফেইসবুক স্ট্যাটাস ঝড় তুলেছে নেট দুনিয়ায়!
মধুপুর সরকারী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন-এর স্ট্যাটাসে ঐ কলেজের কিছু বর্তমান, প্রাক্তন কলেজ শিক্ষক এবং ছাত্র - ছাত্রীরা কমেন্ট করেছেন। কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেখানে কিছু অভিভাবকগণও তাঁদের অভিমত প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে ঠিক মোক্ষম সময়ে স্ট্যাটাসটি সবার মনে এবং হৃদয়ে দাগ কাটতে পেরেছে মনে করছেন সবাই। অনেকে একে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। যিনি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তিনি ঐ কলেজের সহকারী অধ্যাপক (অবসর প্রাপ্ত), ইতিহাস বিভাগ। তিনি ৪০ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র করেস্পন্ডেন্ট হিসেবে। লেখাটি গুরুত্ব পেয়েছে এই কারণেও।
স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, "টাঙ্গাইলের মধুপুর সরকারি কলেজ (বর্তমানে) এমন একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানকার শিক্ষক এবং স্টাফরা অবসরে গেলে কেউ কাউকে কখনো বিদায় সংবর্ধনা দেন না এবং প্রতিদানে কেউ সংবর্ধনা পান না! এজন্য অধ্যক্ষদের ভাগ্যেও কোনদিন বিদায় সংবর্ধনা জোটে না। কয়েক যুগ ধরে লেকচারার, উপাধ্যক্ষ এবং অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর আজ শনিবার অধ্যক্ষ মোন্তাজ আলীর দীনহীন বিদায়ে মনটা বিমর্ষ হওয়ার মর্মবেদনা থেকেই কয়েক ছত্র এ লেখা।
নতুন প্রিন্সিপালকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিদায়ী প্রিন্সিপাল ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত মধুপুর কলেজটি সম্প্রতি সরকারিকরণ হয়েছে। কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন বরেণ্য ব্যক্তি মহেন্দ্র লাল বর্মন। যিনি রাণীভবানী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং মধুপুর থানা আওয়ামীলীগের প্রথম সারির ত্যাগি নেতা ছিলেন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যিনি টাঙ্গাইল-০১ আসন থেকে নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অল্প ভোটে হেরে যান এবং এর দেড় বছরের মাথায় সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনি প্রাণ হারান।
টাঙ্গাইল জেলার এ কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালিন নামকরণ ছিল মধুপুর মহেন্দ্রলাল কলেজ। কিন্তু ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সারাদেশে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজবপন হয়, তারই অংশ হিসাবে এ কলেজ থেকেও মহেন্দ্রলালের নামটি মুঁছে দেয়া হয়। নামকরণ হয় মধুপুর ডিগ্রি কলেজ। এভাবে, শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে এ মহৎ মানুষটি যেমন ঘৃণ্য ঘাতকের হাতে প্রাণ দেন, তেমনি মহেন্দ্রলাল নামটি কলেজ থেকে মুঁছে দিয়ে অকৃতজ্ঞতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়। যদিও মাত্র কয়েক বছর আগে ননঅফিসিয়ালী নামকাওয়াস্তে কলেজ প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে মহেন্দ্র লাল বর্মনের নাম ও ছবি অধ্যক্ষের কক্ষে টানিয়ে রেখে দায়িত্ব সারা হয়। কিন্তু মহেন্দ্র লাল বর্মনের জন্মদিন বা মৃ্ত্যূদিন উপলক্ষে কোন দিনই কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করার ঘটনা আমার মনে পড়ে না। এমন দায়িত্বহীন আচরন যেমন কলেজ কতৃর্পক্ষ করেছেন, তেমনি সুবিবেচনা করেননি প্রয়াত মহেন্দ্র লাল বর্মনের রেখে যাওয়া দল।
প্রায় পাঁচ দশক এ কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন মধুপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি মরহুম হেকমত আলী। দীর্ঘ কয়েক যুগ পর বিদায়কালে তাকেও সম্মানজনকভাবে বিদায় দেয়া হয়নি। এরপর অধ্যক্ষ হন সদ্য অবসরে যাওয়া মোন্তাজ আলী।
এ কলেজে শিক্ষার মান কখনোই খারাপ ছিল না। বহু শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করে সমাজ ও রাষ্ট্রে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও কলেজটি আজ স্বাবলম্বি। যার নেপথ্যে জনাব মোন্তাজ।
রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ করে সরকারি দলের নেতারা সব সময় কলেজ পরিচালনা পরিষদে থেকে এটিকে যুগ যুগ ধরে পরিচালনায় সহযোগিতা করেছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক এবং আওয়ামীলীগ সম্পাদক ও মধুপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরোয়ার আলম খান আবু কলেজ পরিচালনা কমিটির সঙ্গে দেড় যুগ ধরে জড়িত। তারপরও কেন তাঁদের আমলে কলেজের বিদায়ী অধ্যক্ষ, শিক্ষক এবং স্টাফরা কখনোই বিদায়ী সম্মান পাননি, সেটি আজ সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৮৫ সালের শেষ দিকে হেমনগর কলেজ থেকে রিজাইন দিয়ে এ কলেজে যখন যোগদান করি, তখন অনেক বরেণ্য শিক্ষককে আমার সহকর্মী হিসাবে কাছে পেয়েছিলাম। এদের মধ্যে জনাব গোলাম মোস্তফা, জনাব মুজিবুর রহমান, নুরুর রহমান, মতিয়ার রহমান, শহীদুর রহমান, খন্দকার সফিউদ্দীন মনি, গোলাম মর্তুজা, আব্দুর রশীদ, আব্দুল জব্বার, প্রদীপ কুমার, মাওলানা আব্দুল হামিদ, গোলাম সামদানী, সিরাজুল হক আজাদ, সাইদুর রহমান, খোরশেদ আলী, অনুভা রাণী বর্মন, নির্মল কুমার পাল, আবুল হোসেন, মাসুদুর রহমান, আবু নাসের, আব্দুল লতিফ, বাবুল ডি' নকরেক, স্নেহময়গূহ নিয়োগী, রফিকুল ইসলাম মুকুল, বিশ্বজিত ভাদুড়ি, জহিরুল ইসলাম-এর নাম মনে পড়ে। এদের কেউ কেউ আমার পরে যোগদান করেছেন। আবার কেউ কেউ অন্য জবে চলে গেছেন।নয়তো কর্মকালে অথবা অবসরকালে সুদূর পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই আমার স্মৃতিতে জ্বলজলে এবং টক, ঝাল, মিষ্টি বা তেতো সম্পর্ক সত্বেও তারা সবাই আমার শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায় সিক্ত রয়েছেন। সাবেক বা বর্তমান সহকর্মী হিসাবে কারো সাথে কখনো কোন কষ্টদায়ক আচরণ করে থাকলে তাদের নিকট উন্মুক্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
ওই যে, যাদের নাম বললাম, তাঁদের কেউ ই কলেজ থেকে বিদায় কালে, কখনোই একটু ভালোবাসার ছোঁয়ায় বিদায় সংবর্ধনা পাননি। এ জন্য অনেকেই কষ্ট নিয়ে, পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন, তাঁরাও জানেন এ সামান্য সৌহার্দবোধ, সম্মানবোধ তাঁরা কখনোই পাবেন না। কারণ সেই সাংস্কৃতিক চেতনা বোধ, মনের উদারতা, সৌজন্যতা অথবা গুণী জনকে সম্মাননা দেখানোর মানসিকতা সবার মধ্যেই অনুপস্থিত ছিল। অধ্যক্ষরা যেমন মোটাদাগে দায়ী তেমনি অতীত এবং বর্তমানে কর্মরত সকল স্টাফ, গভর্নিং সদস্যরা সমভাবে দায়ী। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন যুগের পর যুগ ধরে এমন অসৌজন্যমূলক, নির্দয়, অনুদার এবং ছোট মানসিকতার চর্চা চলে সেখানে কখনোই মুক্তচিন্তা, উদারবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা, সৃজনশীলতা এবং প্রগতিশীল ভাবনা কতোটা প্রবাহমান থাকবে সেটি একটি প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়।
আজ থেকে প্রায় ৬ বছর আগে যেদিন কলেজ থেকে চির বিদায় নিয়ে আসি, সেদিন ইসলামের ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান বিভাগ আমার সম্মানে একটি ছোট্ট বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। কলেজের শ চারেক শিক্ষার্থী এবং মাত্র জনাদশেক সহকর্মী সেদিন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত সেটিই ছিল মধুপুর কলেজের একজন শিক্ষকের প্রথম বিদায় অনুষ্ঠান এবং আমিই ছিলাম কলেজের ইতিহাসে সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারি। সেদিন সেই অনুষ্ঠানে কলেজের দুই বিভাগের প্রিয় শিক্ষার্থীরা আমার জন্য যেমন অবারিত চোখের জল ঝরিয়েছিল; তেমনি তাদের ভালোবাসায় আমি ছিলাম অশ্রুসিক্ত।
তিন যুগের শিক্ষকতায় কতো সোনালী স্মৃতি বুকে ধারন করে বেঁচে আছি। কিন্তু বিদায় বেলার সেই সুখমিশ্রিত বেদনার স্মৃতি আমাকে এখনো কাঁদায়।
আমার এ লেখাটি যদি বর্তমান সহকর্মীদের কারো নজরে পড়ে, তাদের প্রতি অনুরোধ রইলো, কলেজ থেকে অবসরকালিন বিদায়ে কাউকে সম্মান দেখালে সবার সম্মান বাড়ে। আপনি যদি কাউকে শেষ সম্মান না দেখান, তাহলে আপনি নিজেও বিদায় বেলা কোন সম্মান পাবেন না। যেমনটি করছেন, তেমনটিই পাবেন। যেন শঠে শেঠাং। সবার জন্য শুভকামনা।"
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন - এর স্ট্যাটাসের এক কমেন্ট - এ ঐ কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন প্রভাষক বাবুল ডি' নকরেক একটি দীর্ঘ কমেন্ট লিখেন। সেটি ঐ কলেজের কিছু শিক্ষক, অভিভাবক এবং ছাত্রছাত্রীদের নজর কাড়ে! তাঁরা নকরেক-এর কমেন্ট-এর নীচে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি সেখানে তার অধ্যাপনাকালীন সময়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ফটোগ্রাফিও যুক্ত করেন। ২০০১ সালে শিক্ষা সফরে তাঁর প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে বাবুল ডি' নকরেক, দিনাজপুরে তোলা ছবি নকরেক লিখেন, " আমি আদিবাসী বলে আমার নাম সব সময় বাদ দিয়ে দেন, স্যার?"
তিনি আরও লিখেন, "প্রায় ৪ টি বছর সব অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, অসভ্যতা, নোংরামি সব সহ্য করে কলেজে ছিলাম। ঢাঃবিঃ থেকে ইংরেজিতে অনার্স এবং মাস্টার্স করে ৩৫,০০০ টাকার চাকুরীর অফার পা'য়ে দলে বিনা বেতনে (প্রায় ২ বছর পর আমার বেতন আসে) অধ্যাপনা শুরু করি এই হতভাগা কলেজে ২০০০ সালে !
যেদিন কলেজে যোগ দিতে যাই, সেদিন "গারোর বাচ্চারা কবে থেকে প্রফেসরি শিখেছে?", "সে ইংরেজি পড়াতে পারবে?", "ক্লাস কন্ট্রোল করতে পারবে?" এমন কথা এই কলেজের কিছু শিক্ষকদের মুখে শুনেছি! আমাকে প্রথম ১৪ দিন আর শেষ ৩০ দিন কলেজে ঢুকতেই দেয়া হয় নি!
১৪ দিন পরে, মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর প্রতিনিধি এডিসি এসে আমাকে যোগদান করিয়েছিলেন! স্যার, মনে আছে?
প্রথম দিনেই কিছু শিক্ষকদের এমন ব্যবহারে জেদ চেপে গিয়েছিল! পরিবারের কেউ চাইতেন না আমি মধুপুর কলেজে অধ্যাপনা করি। কারণ আমার পরিবার সব সময় মনে করতেন এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপালকেই কখনও সম্মান করে নাই, আর আমি কী?
স্বপ্নপুরী'তে সহকর্মীদের সাথে বাবুল ডি' নকরেক। নকরেক এর কাঁধে দুহাত রেখে দাঁড়িয়েছে তার প্রিয় এক ছাত্র!
বাপ্পু সিদ্দিকী, কবি, প্রধান শিক্ষক (অবসরপ্রাপ্ত) এবং রাজনিতিক
কিন্তু জেদ ধরেছিলাম, এই কলেজে অধ্যাপনা করবই! শিক্ষামন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, জেলাপ্রসাশক বরাবর চিঠি লিখি এবং মামলা করার হুমকি দিয়ে কলেজে যোগদান করাতে বাধ্য করি! যারা বিরোধিতাকারীরা নাকে খত দিয়ে আমাকে কলেজে যোগদান করাতে বাধ্য হয়েছিলেন। একজন নিরীহ ছেলে এর থেকে আর কীইবা করতে পারত!
তবে বেশিদিন টিকতে পারি নাই! যতদিন টিকেছিলাম অবশ্যই আপনাদের মত কিছু শিক্ষক ছামদানী স্যার, মাসুদ স্যার, হেকমত আলী স্যার, রাজনীতিক জনাব সরোয়ার আলম আবু খান স্যার, জনাব শফিউদ্দিন মনি স্যার, এড ইয়াকুব আলীদের অকৃত্রিম স্নেহ-সহযোগিতার কারণেই। ইংরেজি বিভাগের বর্তমান সহকারী অধ্যাপক বিধান চৌধুরী'র মন্তব্য
আপনি জানেন, কলেজ থেকে পদত্যাগ করার পরেও আমার বাড়ির বিদ্যুৎ লাইন পর্যন্ত কেটে দিয়েছিল; ১২ বছর লেগেছিল সেই সংযোগ ফেরত পেতে? এই কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে আমি সব থেকে বেশী নিগৃহীত হয়েছি! সব থেকে ছাত্র-বান্ধব শিক্ষকও আমিই। নিজের টাকায় সাউন্ড সিস্টেম কিনেছিলাম। কলেজ আমাকে সেগুলো দেয় নি। ৬ নং কক্ষে আর্টস, কমার্স, সাইন্সের ৬০০+ ছাত্রের ক্লাস দিতাম চিৎকার করে চেঁচিয়ে! গলা বসে যেত! সাউন্ড সিস্টেম চেয়ে না পেয়ে নিজেই কিনেছিলাম!
বাধ্য হয়ে রিজাইন করার সময় লিখিয়েছিল 'স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে পদত্যাগ করলাম'। আসার সময় কয়েক লক্ষ টাকা মধুপুর কলেজ আমার বেতন দেয় নাই, মেরেই দিয়েছে! তাই বলেছিলাম "এই টাকা আমাকে আর দেয়ার দরকার নাই! দয়া করে এই টাকা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য লাইব্রেরীতে বই কিনে দিবেন!"
খুব জানতে ইচ্ছে করে, "আমার টাকায় কি ১-২ টা আদৌ বই কেনা হয়েছিল?"
আমার বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছিল, নিজের গ্রামের বাড়িতে।প্রায় ৩০০ ছাত্রছাত্রী বাসায় ফুল আর একটা স্বর্ণের আংটি দিয়েছিল! আমি এখানেই জিতে গেছি, স্যার!
বিরূপ পরিবেশেও ছাত্রছাত্রীরা আমাকে যে সম্মান দেখিয়েছে, সেটাই আমার সেরা প্রাপ্তি! কলেজে ঢুকতে দেয়নি শেষ দিকে। কিন্তু শ পাঁচেক ছাত্রছাত্রী গ্রামের বাড়িতে আমার ওখানে পড়তে যেত কলেজ ছেড়ে দেয়ার পরেও! এর থেকে জীবনের পাওনা আর কী হতে পারে, স্যার?
তবে মধুপুরের হাজার মানুষের, আপনার মত অনেক শিক্ষকের স্নেহ-ভালোবাসার ঋণও তো আছে অনেক। ফেইসবুকে নাম বাদ গেছে তাতে কী? আপনার হৃদয়ে যে স্নেহের নাম লিখেছেন, সে নাম তো আর মুছে ফেলতে পারবেন না!
ছাত্রছাত্রীরা আমার জন্য মিছিল-মানব-বন্ধন করতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, "যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসো তোমারা এসব করো না, ভাল মত পড়াশুনা করে ভাল মানুষ হও", বলেছিলাম তাঁদের ভবিষতের কথা ভেবে! নিজের স্বার্থে তাঁদের ব্যবহার করিনি! যেদিন কলেজ ছাড়ি, সেদিন পিছন ফিরে কলেজের দিকে একবারই তাকিয়েছি; মনে মনে জেদ-সংকল্প করেছিলাম, আমি মধুপুরে একটা বিশ্ববিদ্যালয় করব! এটাই আমার এখন স্বপ্ন! বেঁচে থাকলে হবে ইনশাল্লাহ!"
আপডেটঃ এদিকে বাবুল ডি' নকরেক এর প্রতি অন্যায় আচরণ এর জন্য প্রকাশ্যে তাঁর ফেইসবুক অয়ালে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষমা চাইলেন নকরেক এর প্রাক্তন সহকর্মী। তবে তার উত্তরে নকরেক দীর্ঘ কমেন্ট লিখে জানিয়েছেন, তাঁর এই সহকর্মী নন, ক্ষমা চাওয়া উচিৎ যারা অন্যায় আচরণ করেছিলেন তাদেরই।
নকরেক তাঁর মন্তব্যে লিখেন,
"এক.
আমি খুবী আপ্লুত, স্যার! ২১ বছর পর আমার একজন সহকর্মী, অগ্রজ, প্রগতিশীল শিক্ষক এবং সিনিয়র সাংবাদিক দুঃখ প্রকাশ করলেন, ক্ষমা চাইলেন প্রকাশ্যে!
কিন্তু তাঁর ক্ষমা চাইবার কিছুই ছিল না কারণ তিনি আমার কাছে পিতার মত। আমাকে স্নেহ দিয়েছেন, আদর করেছেন, ভালবেসেছেন এবং সম্মান করেছেন সব সময় অকৃপণ।
দুই.
শিক্ষা অফিসে ঘুষ দিইনি কারণ আমি শিক্ষক, ঘুষ দিয়ে অন্যায়কে উৎসাহিত করব না বলাতে আমার এমপিও হয় নি প্রায় ২ বছর! জয়নাল স্যার প্রতি মাসেই উদ্বিগ্ন থেকে জিজ্ঞেস করতেন, "বেতন কি আসছে, বাবুল?"
প্রায় ২ বছর পর যখন আমার বেতন আসল, আমি মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে বললাম, "দেখছেন? আমরা শিক্ষকরা যদি সবাই ঘুষ না দিতাম, সবার বেতন আমার মত করেই ঘুষ ছাড়াই আসত!"
পরে জেনেছিলাম আমার হয়ে কিছু শিক্ষক শিক্ষা অফিসে 'ঘুষ দিয়ে' আমার বেতন ছাড়িয়ে এনেছিলেন! আর সেই টাকা দিয়েছিলেন ধনবাড়ি মহিলা কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপিকা! ঘুষ টা দিয়ে এসেছিলেন মধুপুর কলেজেরই আরেক সহকারী অধ্যাপক!
এই স্নেহের, ভালোবাসার ঋণ গুলো তো আমি কোনদিন শোধ করতে পার না, স্যার!
জয়নাল স্যারের অসম্ভব মেধাবী ২ মেয়ে! তাঁদের ইংরেজি পড়বার দরকার ছিল না। আমি নিজেই তাঁদের বলেছি, "তোমরা সময় নষ্ট করে প্রাইভেট পড়তে এসো না! তোমরা এমনিতেই ৭০+ পাও! প্রাইভেট পড়ার দরকার টা কী? প্রাইভেট পড়বে যারা পাস করতে পারছে না!"
কিন্তু তিনি তাঁর দুই মেয়েকে আমার এখানে পাঠাতেন। টাকা নিতে চাইতাম না, কিন্তু অনেক টা জোড় করেই দিতেন! মেয়েরা বলত, "স্যার, বেতন ফেরত দিলে কিন্তু আমরা আর পড়তে আসব না!" আসলে এত মেধাবী ছাত্রীদের পড়ানোর লোভ টাও সামলাতে পারিনি। কারণ আমি প্রতিদিন তাঁদের কাছ থেকে কত কিছু শিখতাম ...
তিনি প্রায়ই বলতেন, 'নকরেক সাহেব, মধুপুর কলেজ বুঝি আপনার মত মেধাবী শিক্ষককে আর ধরে রাখতে পারল না!" এই বলে মাথা এদিক অদিক নাড়াতেন।
পাঁচ.
একবার ডঃ রাজ্জাক এমপি আমাকে কলেজে এসে খুঁজলেন! বললেন গাড়িতে উঠো একটা জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাব ! আমি একটু বিব্রত! কিন্তু একজন সম্মানিত এমপি মহোদয়কে 'না' করার সাহস আমার তখনও হয় নি! সেদিন থেকেই আমার মনে হল, আমার উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল! কিন্তু আমার মনে হয় সেদিন বিএনপির কোন এমপি এসে এমন কথা বললেও আমি 'না' করে দিতে পারতাম না!
ছয়
"আপনার প্রতি এমন আচরনের জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।" এই কথা জয়নাল আবেদীন স্যার - এর মত মানুষ যখন বলছেন, তখন আমি নত হয়ে যাই লজ্জায়---
সাত.
আমি আবেগী মানুষ ঠিক! কিন্তু আমার কান্না সহজেই পায় না। মানুষ মারা গেলেও আমার চোখে সহজে জল আসে না। আজকে চোখের কোণে মেঘ করেছে! আজ মনে হয় আমার কাঁদবারই দিন ...
আমি থানা পুলিশে গিয়ে ১ টা মামলা এমন কি ১ টা জিডি করতে পারি নাই! আমার কোন মামলা, জিডি আমলে নেওয়া হয় নাই!
তবে আমি সেদিনই ক্ষমা করব ঐ সকল শিক্ষকদের, মধুপুর সরকারী কলেজ আমার বাধ্য হয়ে রিজাইন করে চলে আসার সময় যে পাওনা বেতন আমাকে দিতে পারেনি, যেদিন আমার বেতনের বাকী কয়েক লক্ষ টাকায়, আমার অনুরোধ মোতাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য লাইব্রেরীতে বই কিনে দেওয়া হবে! তার আগে নয়। সেগুলোর হিসেব আমি কিংবা আমার মত মানুষ নিতে পারে নাই, উপরওয়ালা যেন সে হিসেব নেন! আইনের আওতায় বিচার চাওয়ার অধিকার যেহেতু পাই নাই, তাই এই নালিশ, বিচার সৃষ্টিকর্তার কাছে ২১ বছর আগেই দিয়ে রেখেছি আমি, তিনিই উত্তম বিচারক ...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for supporting